বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা :
হিংসা সীমা ছাড়িয়ে গেল পশ্চিমবাংলার চতুর্থ দফার ভোটে। অধিকাংশ কেন্দ্র থেকেই হিংসা, ছাপ্পা ভোট দেওয়া, প্রার্থীর এজেন্টদের ভোট দিতে না দেওয়া, প্রার্থীর ওপর আক্রমণ, হুমকির ঘটনার খবর এসেছে। কিন্তু হিংসার চরম বিন্দু ছুঁয়েছে শীতলকুচি। সেখানে গুলিতে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মৃতদের মধ্যে চারজনই কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এত সবের মধ্যেও ভোটদানের হার খারাপ কিছু ছিল না। এদিন বিকেল পর্যন্ত মোট ভোট পড়েছে ৭৬ শতাংশেরও বেশি।
শনিবার চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণ শুরু হতেই প্রথম হিংসার ঘটনা ঘটে শীতলকুচিতে। এখানকার পাগলাপির এলাকায় আনন্দ বর্মন নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়। কয়েকদিন আগে শীতলকুচিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ভোটের দিন সেই শীতলকুচির পাঠানপুলি এলাকায় ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের কাছেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই তরুণের মৃত্যু হয়। গোটা ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। মৃত যুবক আনন্দ বর্মন তাদের কর্মী ছিলেন বলে বিজেপির দাবি। একই কথা বলেছে আনন্দের পরিবারও। ভোটের লাইনেই গুলি করা হয় আনন্দকে। অভিযোগ বিজেপির। মৃত তরুণের পরিবারের দাবি মাত্র ১৮ বছরের আনন্দ প্রথম ভোট দেওয়ার জন্য সকাল সকাল ভোট গ্রহণকেন্দ্রের দিকে রওনা দেন। কিন্ত ভোট কেন্দ্রের কাছেই তাঁকে গুলি করা হয়। বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা গুলি করেছে।
এর পরই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে শীতলকুচিরই জোড়পাটকির ১২৬ নম্বর বুথের বাইরে। সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরে তিনশো থেকে চারশোজন স্থানীয়রা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বাহিনীর জওয়ানরা গুলি চালায়। ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়। আরও চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার পরই রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর তরফে দাবি করা হয়েছে, আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় পশ্চিমবাংলার রাজনীতি। শীতলকুচিতেই আরও এক বিজেপি কর্মীর মুখে বোতল ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত বিজেপি। শীতলকুচির পাশাপাশি কোচবিহারেরই দিনহাটা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী উদয়ন গুহের ওপরও হামলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত বিজেপি। যদিও তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে আইএসএফ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকির ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সেখানকার ২৫১–২৫২ নম্বর বুথে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ার পথে বাধা দিয়েছে বলেও অভিযোগ। আবার, সেখানেই আইএসএফ কর্মীদের বাড়িতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ উঠেছে। হুগলির চুঁচুড়ার বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের গাড়িতেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত তৃণমূল। ঘটনায় ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ব্যান্ডেলের ঈশ্বরবাহারের কাছের একটি বুথে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ এনে পুনর্নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছেন লকেট। পাশাপাশি হাওড়ার বালিতে বিজেপি প্রার্থী বৈশালী ডালমিয়ার কনভয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে। তাঁর অভিযোগ, লিলুয়ার একটি বুথ থেকে বারবার অভিযোগ আসায় বিকেলে সেখানে যাচ্ছিলেন। পথে কনভয়ের ওপর হামলা চালায় তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। এই বালিতে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে তীব্র সঙ্ঘর্ষ হয়। সেখানে বোমাবাজিও হয়।
আবার, সোনারপুর উত্তর বিধানসভায় রানা ভুতিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারটি বুথের ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কলকাতার কসবায় বিজেপি প্রার্থী ড. ইন্দ্রনীল খাঁকে জুতো দিয়ে মারে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন তিনি। এখানেই পুলিশের মদতে বিজেপি কর্মী–সমর্থকদের বাড়ি এবং দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত তৃণমূল। এ ছাড়া কলকাতার যাদবপুরে বিজেপি এজেন্টকে মেরে মুখ–চোখ ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। বেহালায় বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুরও করা হয়। অভিযুক্ত তৃণমূল। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগানে এক সিপিএম এজেন্টের চোখে লঙ্কার গুঁড়ি ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে সিপিএম।
চতুর্থ দফায় মোট ৪৪টি আসনে ভোট হয়। এদিন ৩৭৩ জন প্রার্থীর ভাগ্য পরীক্ষা হয়। হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও এদিন ভালোই ভোট হয়েছে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এদিন ভোটদানের হার ছিল ৭৬.১৬ শতাংশ। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই হিসেব ৮০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আলিপুরদুয়ারে ভোট পড়েছে ৭৩.৬৫ শতাংশ, হাওড়ায় ৭৫.০৩ শতাংশ ভোট পড়েছে, হুগলিতে ৭৬.০২ শতাংশ ভোট পড়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৭৫.৪৯ শতাংশ ভোট পড়েছে, কোচবিহারে ৭৯.৭৩ শতাংশ ভোট পড়েছে।